আমার প্রথমবার ভারত যাওয়া হয়েছে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে। ব্লগ লেখার দিন থেকে খুব বেশীদিন আগে না। দেশের বেশীভাগ মানুষ ভারতে প্রথমবার গেলে যায় কলকাতা, আমার যেতে হয়েছে চেন্নাই। এর আগের ব্লগ পোস্টে ভারতীয় ভিসা নিয়ে লিখেছিলাম, এইবার লিখতে বসেছি এই ভারত ভ্রমন নিয়ে।

বাংলাদেশে আমার বাবার চোখের ডাক্তার বলেছিলেন রেটিনার সার্জারী লাগবে, একটু ভিন্ন ধরনের অসুখের জন্য আমার শ্বশুরকেও তার চোখের ডাক্তার একই কথা বলেছিলেন। চোখের ব্যপার অনেক সেনসিটিভ ভেবে আমরা সিদ্ধান্ত নেই সার্জারী যদি করতেই হয় করাবো শংকর নেত্রালয়ে। সাউথ এশিয়াতে এই হাসপাতালের বেশ নামডাক আছে। খুব ভালো চোখের চিকিৎসা হয়। এই হাসপাতালের মেইন ব্রাঞ্চ ভারতের চেন্নাইতে। সেখানে যাওয়ার জন্যই আব্বুর, আম্মুর, আমার শ্বশুরের আর শ্বাশুরীর জন্য মেডিকেল ভিসা আর মেডিকেল এ্যটেন্ডেন্ট ভিসা করাই। আমি আর আমার স্ত্রী প্লান করি সাথে যাবো তাদের। ডাক্তার দেখানোও হবে, নতুন দেশ থেকে ঘুরেও আসা হবে।

আমাদের স্পাইসজেট ফ্লাইটের সাথে যাওয়ার সময় তোলা ছবি

বাংলাদেশ থেকে ভারত যাওয়ার অনেক ব্যবস্থা আছে। আমরা যেহেতু যাচ্ছিলাম রোগী নিয়ে, সবচেয়ে দ্রুততম ব্যবস্থা (প্লেনে) বেছে নিতে হয়েছে। আর আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন ঢাকা চেন্নাই সরাসরি কোন ফ্লাইট ছিলোনা। এখন অবশ্য ইউ এস বাংলার সরাসরি ফ্লাইট আছে। সাথে রোগী নিয়ে গেলে এয়ারপোর্টে সাধারন সময়ের চেয়ে এক ঘন্টা সময় বেশী হাতে নিয়ে যাবেন। অনেক সময় এয়ারপোর্টের ডাক্তারের কাছে থেকে ফিট টু ফ্লাই সার্টিফিকেট নিতে হয়।

যাওয়ার সময় তিন ঘন্টার ট্রানজিট ছিলো কলকাতায়। কলকাতায় ইমিগ্রেশন শেষ করে নিজের লাগেজ নিজেরই রিসিভ করে টেনে নিয়ে আবার ডমেস্টিক টার্মিনালে গিয়ে জমা দিয়ে কলিকাতা চেন্নাই ফ্লাইটে বোর্ডিং করতে হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে ঢাকা চেন্নাই ফ্লাইটে লাগে ৪৫ মিনিট, কিন্তু কলিকাতা চেন্নাই ফ্লাইটে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘন্টা। দেশে থাকতে ভেবে পাচ্ছিলাম না কিভাবে এই তিন ঘন্টার ট্রানজিটের সময় কাটবে। কলকাতা এয়ারপোর্টে ঘুরতে ঘুরতেই সময় কেটে গেল। এমনকি এয়ারপোর্টের ভিতরে মাটির কাপে চা পেলাম!

অন্য দেশের চেয়ে ভারতে সিম কার্ড কেনাটা হাল্কা একটু কষ্টকর। তার উপরে কিছু চিনিনা। একটা নাম্বরে রোমিং করা ছিলো, তাও ২জির উপর ইন্টারনেট পেলাম না, সেটাতে কোনভাবে ম্যপ বের করে হোটেলের ম্যপ বের করে দুইটা প্রিপেইড ট্যাক্সি নিলাম। এয়ারপোর্টের ভিতরেই বুথ আছে এদের। খরচ বেশী, কিন্তু সেফটি নিয়ে ইশু নাই। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের হোটেল পর্যন্ত ৫০০ রুপি করে নিলো প্রতি ট্যাক্সি। এয়ারপোর্টে অল্পকিছু ডলার ভাংগিয়ে চলে গেলাম হোটেলে।

আমরা বুক করেছিলাম ট্রীবো হোটেলস এর একটা হোটেল। ট্রীবোর হোটেলগুলোর খরচ কম, কিন্তু সার্ভিস খুব ভালো। আমাদের হোটেল ছিলো একটা মোটামুটি শান্ত আবাসিক এলাকায়, শংকর নেত্রালয় থেকে বেশ কাছে। যেকোন যায়গায় গেলে প্রথমেই যেটা করা দরকার সেটা হচ্ছে যেখানে থাকছি সেখানকার কাছাকাছি কোন ল্যান্ডমার্ক (সবাই চিনবে এমন) কিছু খুজে বের করা। এতে ঠিকানা বলতে সুবিধা হয়, আবার হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে কম। সবাইকে শিখিয়ে দিলাম "ডন বসকো স্কুল এগমোর" বললেই আমাদের হোটেলের খুব কাছে নামিয়ে দিবে।

আসতে আসতে রাত হয়ে গিয়েছিলো। কেনমতে ঘুমিয়ে পরের দিন বের হলাম চেন্নাই এক্সপ্লোর করতে। প্রথমে সিম কেনার অভিযানে নামলাম।চেন্নাইতে খুব পপুলার এলাকা এ্যপোলো হাসপাতালের এলাকা। এখানে বিদেশীদের আনাগোনা অনেক বেশী। যায়গাটার নাম গ্রীমস রোড। এখানে আমাদের হোটেল থেকে হেটেই যাওয়া যায়, গ্রীমস রোডে গিয়ে একটা দোকান থেকে সিম কার্ড কিনলাম, ডলারও এক্সচেঞ্জ করলাম কিছু। এখানকার রেট এয়ারপোর্ট থেকে অনেক ভালো।গ্রীমস রোড ঘুরতে ঘুরতে লাঞ্চের সময় হয়ে গেল। হালাল খাবার খোজাটা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যপার। বাংগালী খাবারের অনেক ছোট বড় হোটেল আছে গ্রীমস রোডে, বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ আসে এখানে এ্যাপোলোতে মুলত তাদেরকে টার্গেট করেই বিশাল একটা মার্কেট আছে এখানে। তবে কোন বাংলা খাবারের দোকান সেইরকম পরিস্কার মনে হলো না, তাই আরো একটু খুজলাম, আর পেয়েও গেলাম Palm jumeirah, নামে একটা মাল্টি কুইজিন রেস্টুরেন্ট। ১২ পাতার পুরা মেনু কয়েকবার দেখে প্লেইন রাইস, ডাল তরকা, লুজ প্রনস, ভেজিটেবল অর্ডার করলাম। খাবারের টেস্ট অসম্ভব রকম ভালো ছিলো। সাথে বাংগালিট ক্ষুধার্ত পেট, পুরা চেটেপুটে খেয়ে ফেললাম। তবে পাম জুমেরাতে খাবার কিন্তু একেবারে সস্তা না। আবার আমাদের দেশের অভিজাত খাবারের দোকানের সাথে তুলনা করলে অনেক রিজোনেবল।

এর পর গেলাম চেন্নাইয়ের সি বিচ, মেরিনা বিচে। সিম কেনার পর থেকে Ola সার্ভিসেই বেশী যাতায়াত করেছি। সেফটিও ভালো, খরচও তুলনামুলক ভাবে অনেক কম। তবে কয়েকবার চলাচল করলে সেখানকার অটোরিক্সার ভাড়া নিয়েও আইডিয়া হয়ে যাবে। আর আমার সাথে ছিলো বার্গেইন করাতে গোল্ড মেডেলিস্ট আমার বউ। অটোওয়ালার সাথে এমনে বার্গেইন করে আমি নিজেই ভয় পেয়ে যাই। পরে দেখি আবার তার বলা ভাড়াতেই যাচ্ছে অটো। যাই হোক, মেরিনা বিচে গিয়ে পৌছালাম ভর দুপুরে। সেইরকম রোদ আর গরম। তাও সমুদ্র বেশ ভালোভাবেই উপভোগ করলাম সবাই। বিশেষ করে আমার বাবা মা, যারা এর আগে কখনোই সমুদ্র দেখেননি।

মেরিনা বিচে ভর দুপুরে তোলা ছবি

বিচ ঘুরে ঘুরে বিকেল হয়ে গেল, শপিং সেন্টার এখনো দেখাই হয়নি। গুগল ম্যাপ ঘেটে ডিসিশন নিলাম এক্সপ্রেস এ্যভিনিউ শপিং সেন্টারে যাবো। সবাই মিলে গেলাম। গিয়ে দেখি স্টারবাক্স আছে এখানে! সাথে সাথে কফি নিয়ে নিলাম একটা। অন্যরা স্ন্যক্স ট্রাই করলো কিছু। এক্সপ্রেস এ্যভিনিউ সবচেয়ে বড় আর অভিজাত শপিং মল এখানে। অনেক ইন্টারন্যাশনাল ব্রান্ড আছে এখানে। আমি তেমন কিছু কিনি নাই এখানে থেকে, শুধু ৮ টা সানগ্লাস কিনেছি 🤣। চেন্নাইতে শপিং সেন্টার বন্ধ হয় রাত ৮ টা ৩০ মিনিটে। শুধু শনি আর রবিবার বন্ধ হয় ৯ টায়। ঠিক ৮ টা ৩০ এ শপিং সেন্টার বন্ধ হয়ে গেল। আমরাও হোটেলে ফিরলাম।

পরের কয়েকদিন সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত কাটলো শংকর নেত্রালয়ে। আব্বুকে দেখলো গ্লুকোমা, রেটিনা আর নিউরোর ডাক্তার। আমার শ্বশুরকে দেখলো রেটিনার ডাক্তার। তারপর দুইজনকেই চশমা পালটায়ে দিয়ে বললো কারোরই অপারেশন করার কোন দরকার নাই। শংকর নেত্রালয় হাসপাতালটা আমার খুবই ভালো লেগেছে। এখানকার সার্ভিস আর চিকিৎসা আসলেই অনেক মানসম্মত। ডাক্তাররা প্রতিটা অবজারভেশন আর ডিসিশন সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়।

শংকর নেত্রালয়

চোখের ডাক্তার দেখাতে প্রায় তিন দিন লেগে গেল। আমি আর আমার স্ত্রী প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে হোটেলে ফিরে বের হয়ে এক্সপ্রেস এভিনিউ গিয়েছি। যেতে যেতে দেখা যেত শপিং মল বন্ধ হওয়ার এক ঘন্টা আগে পৌছেছি বেশীভাগ দিন।

চোখের চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর গেলাম আব্বু আম্মুকে নিয়ে এ্যপোলো হাসপাতাল। আম্মুকে কিডনীর জন্য আর আব্বুকে দেখালাম অর্থ্রোপেডিক সার্জন। এখানেও খুবই মানসম্মত ভালো চিকিৎসা পেয়েছি। তবে এ্যপোলোর খরচ একটু বেশী। তবে সুবিধা হলো, এই কারনে ভালো ডাক্তারের সিরিয়াল পাওয়া সহজ।

আসার আগের দিন সবাই শপিং করতে বের হলাম।এই কয়দিনে আমাদের চেন্নাইয়ের আরো কিছু শপিং সেন্টার দেখা শেষ। যা বুঝলাম, শপিং করার জন্য এক্সপ্রেস এভিনিউ সবচেয়ে ভালো। এই মার্কেটের বেইজমেন্টে আছে বিগ বাজার। সেখানে গিয়ে সবাই একগাদা চকলেট বিস্কুট আর কসমেটিকস এর জিনিসপত্র কিনলো। আমি ফাস্টট্রাক থেকে আরো দুইটা সানগ্লাস কিনলাম, বউ কিছু ব্যাগ কিনলো।

ফিরে আসার দিন এয়ারপোর্টে আসলাম ওলায়। ওলার একটা প্যাকেজ আছে, ওলা প্লে। গাড়ির ইন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেম ওলার কাস্টম হার্ডওয়্যার। গাড়ির ওয়াই ফাই ব্যাবহার করেই নিজের পছন্দের গান প্লে করা যায়। আমি যখনই ওলায় উঠেছি, এ আর রহমানের গান প্লে করেছি। এ আর রহমান এর হোমটাউন চেন্নাই। এখানকার মানুষ তাকে অনেক পছন্দ করে।

ওলার নিজস্ব ডিভাইস

চেন্নাইয়ের মানুষগুলো অসম্ভব রকম ভালো। আপনি তাদের সাথে হেসে কথা বললে, যতই সিরিয়াস মুডে থাকুক, হাসিমুখেই উত্তর দিবে। এই একটা ব্যাপারের জন্য তাদের কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। সামর্থ্য আর সুযোগ হলে, আবার যাবো।